প্রকাশিত: ০৪/০৬/২০১৮ ৩:৩৭ পিএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ২:১০ এএম

জুবায়ের চৌধুরী::
ইয়াবার বিস্তার দিন দিন বেড়েই চলেছে। গ্রামগঞ্জের পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে শহরের অলিগলি কোথাও বাদ নেই, যেখানে হাত বাড়ালেই ইয়াবা মেলে না। এই ইয়াবার ছোবলে নষ্ট হচ্ছে তরুণ প্রজন্ম। হাজার কোটি টাকার বাজার গড়ে ওঠেছে এই মরণ নেশাকে কেন্দ্র করে। যদিও তা সম্পূর্ণ কালোবাজার। নিষিদ্ধ মার্কেট। এই সর্বনাশা নেশার একমাত্র উৎপাদক দেশ মিয়ানমার। তবে চমকে দেওয়া তথ্য হচ্ছে, দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে চট্টগ্রাম ও ঢাকাসহ দেশের ভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠেছে ভেজাল ইয়াবা কারখানা! এই ভেজাল ইয়াবায় বাড়ছে আসক্তদের আকাল মৃত্যুর আশঙ্কা। সরেজমিন অনুসন্ধান ও গোয়েন্দা সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

বাজার থেকে ইয়াবার আকারে নানা ধরনের ট্যাবলেট কিনে তাতে রঙ আর ইয়াবার গন্ধ মিশিয়ে তা বিক্রি হচ্ছে। শুধু বিক্রিই নয়; খোদ ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় এ ধরনের নকল ইয়াবা তৈরির কারখানারও সন্ধান পাওয়া গেছে। তাছাড়া বিভিন্ন সময় রাসায়নিক পরীক্ষাতেও উদ্ধার করা বেশির ভাগ ইয়াবায় এর মূল উপাদান পাওয়া যায়নি। ইয়াবা ছাড়াও নকল ফেনসিডিলসহ মাদক তৈরির কারখানার খোঁজ প্রায়ই মিলছে। আর এবার দেশব্যাপী চলমান মাদকবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে ইয়াবা কারখানাগুলোর সন্ধানে মাঠে নেমেছে গোয়েন্দারা।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, ইয়াবা তৈরির মূল উপাদান মিথাইল অ্যামফিটামিন এবং ক্যাফেইন। একটি ট্যাবলেটে ৩০ থেকে ৩৫ মাত্রার মিথাইল অ্যামফিটামিন এবং বাকিটা ক্যাফেইন। তবে দেশে আটক বেশিরভাগ ইয়াবার ক্ষেত্রে সে পরিমাণ উপাদানের উপস্থিতি নেই। এসবের সঙ্গে নানা ক্ষতিকর কেমিক্যাল ও বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির তৈরি ঘুমের ট্যাবলেট মিশানো হচ্ছে যেগুলো মৃত্যুর ঝুঁকি আরো বাড়ায়। অন্যদিকে যৌন উত্তেজনা বাড়াতে এসবের সঙ্গে মিশানো হচ্ছে ভায়াগ্রাসহ নানা যৌন উত্তেজক ট্যাবলেটের গুঁড়া। ইয়াবার মতো ভয়ঙ্কর মাদক তৈরির উপাদান আমদানির ওপর কড়া নজরদারি করা উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

জানা গেছে, বিদেশ থেকে আসা ইয়াবার চেয়ে দেশে তৈরি ইয়াবায় বেশি নেশা হয়। আসল ইয়াবার চেয়ে পাঁচগুণ বেশি ঝুঁকিও আছে ভেজাল ইয়াবায়। কম দামে পেয়ে আসক্তরা দেশে তৈরি ইয়াবা বেশি কেনে। শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক এই ভেজাল ইয়াবাতেই তুষ্ট মাদকসেবীরা। অন্যদিকে একটি চক্র রাজধানীসহ সারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় নকল ইয়াবা কারখানা গড়ে তুলেছে। বাজার থেকে ইয়াবার আকারে নানা ধরনের ট্যাবলেট কিনে তাতে রঙ আর ইয়াবার গন্ধ মিশিয়ে তা বিক্রি হচ্ছে। ইয়াবা তৈরির মূল উপাদান মিথাইল অ্যামফিটামিন এবং ক্যাফেইন। তবে দেশে এ পর্যন্ত জব্দ হওয়া বেশিরভাগ ইয়াবার ক্ষেত্রে মিথাইল অ্যামফিটামিন ও ক্যাফেইনের উপস্থিতি পাওয়া যায় না।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ২০০৭ সালের পর প্রায় অর্ধশত ইয়াবা কারখানার সন্ধান পাওয়া যায়। তবে গত কয়েক বছরে শুধু ঢাকাতেই অন্তত পাঁচটি নকল কারখানার সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব কারখানার মধ্যে বছর তিনেক আগে সন্ধান পাওয়া ‘জুবায়েরের ইয়াবা কারখানা’ ছিল সবচেয়ে বড়। রাজধানীর নিকেতনের একটি ফ্ল্যাটে আবদুল্লাহ জুবায়ের নামে মিয়ানমারের ওই নাগরিক ইয়াবা তৈরির কারখানা গড়ে তুলেছিলেন। তবে উৎপাদনের আগেই জুবায়ের গত বছর ডিবি পুলিশের হাতে ৫০ হাজার পিস ইয়াবা, পাজেরো গাড়ি, ইয়াবা তৈরির মেশিনসহ গ্রেফতার হন।

ওই সময় জুবায়ের জানিয়েছিলেন, মিয়ানমার থেকে ইয়াবা পাচার করতে অনেক টাকা খরচ হয়। তাই তিনি মেশিন বসিয়ে ঢাকাতেই নকল ইয়াবা তৈরি করে তা বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন। একই সময়ে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় ইয়াবা তৈরির নকল কারখানার সন্ধান পায় ডিবি পুলিশ। ওই কারখানা থেকে সহস্রাধিক ইয়াবা, কাঁচামাল, সরঞ্জামসহ চারজনকে আটক করা হয়। ওই কারখানার মালিক ছিলেন আলী আকবর। আটকের পর আলী আকবর জানিয়েছিলেন, তিনি শুরুতে ওষুধের নকল কারখানা স্থাপন করলেও চাহিদা থাকায় এবং লাভ বেশি হওয়ায় ইয়াবা উৎপাদন করে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে খুচরা ও পাইকারি বিক্রি করে আসছিলেন। এর আগে ২০১২ সালে রাজধানীর মধ্য বাসাবো এলাকায় অভিযান চালিয়ে ইয়াবা তৈরির নকল কারখানা আবিষ্কার করে পুলিশ। এছাড়া একই বছর চট্টগ্রামের বাকলিয়ার রসুলবাগ এলাকাতে ইয়াবা তৈরির নকল কারখানা আবিষ্কার করে পুলিশ। ওই কারখানার মালিক শ্যামল মজুমদারকে আটকের পর ৫ হাজার পিস নকল ইয়াবা ও ইয়াবা তৈরির কাঁচামাল জব্দ করা হয়।

বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হওয়া নকল ইয়াবা কারখানার মালিকরা জানান, সোডিয়াম বেনজোয়েট, ক্যাফেইন ও ভেনিলার পাউডার মিশিয়ে তারা নকল ইয়াবা তৈরি করেন। অনেক সময় ছোট আকারের ওষুধ কোম্পানি থেকে ইয়াবা সাইজের ট্যাবলেট তৈরি করিয়ে সেসব ট্যাবলেটে শুধু ইয়াবার ফ্লেভার (গন্ধ) মিশিয়ে তা ইয়াবা আকারে বিক্রি করা হয়। এসব নকল ইয়াবা পরিচিত ডিলারদের কাছে প্রতি পিস ৩০ টাকা এবং অপরিচিত ডিলারদের কাছে বিক্রি করা হয় তা ৮০ থেকে ৯০ টাকায়। একপর্যায়ে এই ভেজাল ইয়াবা মাদকসেবীদের কাছে পৌছায় ১৫০ থেকে ২০০ টাকায়।

আদালতে দেওয়া সাক্ষীতে ভেজাল ইয়াবা উৎপাদনকারীরা বলেছেন, ঠা-ার ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত সিডোইফিড্রিন কিংবা এ জাতীয় রাসায়নিকই অ্যামফিটামিন বা ইয়াবার মূল উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলো অতীতের তুলনায় সিডোইফিড্রিন আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি করায় গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে এই রাসায়নিকের আমদানি বন্ধ করে সরকার। আমদানি নিষিদ্ধ হওয়ার পর এই রাসায়নিক অনেকটা দু®প্রাপ্য হয়ে যাওয়ায় তারা নতুন পদ্ধতি গ্রহণ করেন। যেসব ওষুধে এই রাসায়নিক থাকে সেগুলোতে থেকে সিডোইফিড্রিন আলাদা করে কাজ চালান তারা।

২০০৭ সাল থেকে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ৫০টিরও বেশি ইয়াবা কারখানার সন্ধান পেয়েছে। দেশে এমন আরো অনেক ছোট ছোট কারখানা রয়েছে বলেও ধারণা তাদের। এ বিষয়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের ডিআইজি বনাজ কুমার মজুমদার বলেন, যেসব কারখানার সন্ধান মিলেছে সেগুলো অনেক ছোট আকারে ছিল এবং একটি ছোট রুমেই সব যন্ত্রপাতি ছিল। সব কারখানার বেশিরভাগই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের আশপাশে অবস্থিত বলে জানান তিনি। পুলিশের এই কর্মকর্তা আরো বলেন, স্থানীয় উৎপাদনকারীরা মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবার সঙ্গে এগুলো মিশিয়ে বিক্রি করেন।

তবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক জামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত এসব ইয়াবায় সাধারণত ভেজাল থাকে। গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের বেপারি পাড়ায় গোয়েন্দারা একটি ইয়াবা কারখানায় অভিযান চালিয়ে চারজনকে আড়াই লাখ পিস ইয়াবা, ১০০ কেজি রাসায়নিক, দুইটি মেশিন এবং চারটি ছাঁচসহ চারজনকে গ্রেফতার করা হয়। যেসব উপাদান ওই অভিযানে উদ্ধার করা হয়েছিল সেগুলো থেকে প্রায় ১০ লাখ পিস ইয়াবা তৈরি করা যেত।

ডিএনসি মহাপরিচালক আরো জানান, ইয়াবা তৈরির কাঁচামাল দেশের বাইর থেকে আসছে। দেশের ভেতরে ইয়াবার কারখানা আবিষ্কার হওয়াটা অবশ্যই উদ্বেগজনক। চলতি বছরের শুরুতেই নারায়ণগঞ্জে এমন একটি কারখানার সন্ধান মিলেছে। সেই কারখানায় তৈরি করা হতো নকল ইয়াবা। এবার ইয়াবা কারখানাগুলো খুঁজে বের করতে যৌথ অভিযান শুরু করেছে ডিএনসি।

পাঠকের মতামত